চাঁদের দেশ "নাথাং ভ্যালি" (Part 2)
দুপুরে খাওয়ার পর চঞ্চল মন কে খানিকক্ষণ বিশ্রাম দিয়েই আমি ও আমার পরিবারের সবাই ছড়িয়ে পড়লাম নাথাং এর আনাচে কানাচে । প্রথমেই পৌঁছে গেলাম ব্রিটিশ সিমেটেরীতে । বেশ কিছুটা উঁচুতে থাকা, পাথরে বাধানো ছোট্ট কবর স্থানটি রেলিং দিয়ে ঘেরা । প্রায় দশটি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করেই সেখানে পৌছতে হয় । উপরে উঠেই দেখি সুন্দর ভাবে সাজানো প্রায় দশ-বারোটা কবর. সমগ্র ভ্যালির শোভা এখান থেকে আরো সুন্দর দেখায় । তবে তীব্র হওয়ার দাপটে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না, চললাম ভ্যালির মাঝে থাকা ছোট মাঠটির দিকে । যাওয়ার পথে চোখে পড়ল রাস্তার দুপাশে সুন্দর ভাবে সাজানো ছোট ছোট টিনের ঘর । প্রতিটি ঘরের সামনে রযেছে চিমনির মতো ছোট প্রদীপ জ্বালাবার স্থান । যার পাশে লেখা ফ্রি টিবেট । প্রতিটি বাড়িতেই দেখা মেলে লোমওয়ালা ছোট ছোট কুকুরের । চারপাশের উষ্ণতা হিমাঙ্কের নীচে হওয়ায় নাথাং-এর সমস্ত নালা জমে বরফ । যেখানেই জলের স্পর্শ সেখানেই বরফ । এমনকি দূর পাহাড় হতে আসা পাইপ দ্বারা পরিবাহিত ওয়াটার সাপ্লাই এর নল গুলির মুখের নিচেও জমাট বাধা বরফ এর চাঁই । এই বরফ এর শুভ্রতা দেখতে দেখতেই উঁচু-নিচু পিচের পথ বেয়ে এগিয়ে চললাম এক লোহার ব্রিজের দিকে, যা পার করে কিছুতা এগোলেই এক ছোট সমভূমি । পথের পাশে চোখে পড়ল একটা ছোট রেশন দোকান ও একটি হেলথ সেন্টার । তবে নাথাং এর মানুষ জন বড়ই লাজুক , এক বাড়ির সামনে দাড়িয়ে এক বয়স্ক মহিলাকে ফটো তলার প্রস্তাব দিতেই লাজুক হেসে বাধা দিলেন। উচ্চতা বেশি হওয়ার দরুন চলা-ফেরা বেশি করলে হালকা কষ্ট অনুভূত হছিল । যাই হোক মনের জোরকে সঙ্গী করে পৌছলাম সেই সমাভুমিটিতে । পৌছেই তো আমি অবাক যেখানে বেশি হাটাচলাতে আমাদের কষ্ট অনুভূত হছিল সেখানে দেখি একদল ছেলে ব্যাটবল নিয়ে ক্রিকেট খেলছে । ওদের সাথে কথা বলে জানলাম ক্রিকেট এখানে বেশ জনপ্রিয় । যদিও সমগ্র সিকিম বেশিরভাগ সময়ই ফুটবল জ্বর-এ আক্রান্ত থাকে । সমভূমিটির চারপাশে সুউচ্চ পাহাড় রাশি , আকাশের নীল আভা , অদূরে চরে বেড়ানো ঘোড়ার দল ও এককোনায় থাকা রঙিন মন্দিরটি আমায় মোহময় করে তুলেছিল । বেশ কিছুটা দুরেই ছিল প্রায় জমাট বাধা এক জলাভূমি, যেখানে দেখা মিলল দুটি হিমালয়ান 'রুডি সেল ডাক' এর । আমি চুপিসারে তাদের কাছে গিয়ে ক্যামেরা বন্দী করলাম তাদের অপরূপ শোভা । এরপর পাড়ি দিলাম একপ্রান্তে থাকা মন্দিরটির দিকে । নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে হলদে-লালে রাঙ্গা মন্দিরটি ভারী সুন্দর লাগছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল জমাট বাধা এক জলাভূমি । জনশ্রুত এতে নাকি অনেক মাছ থাকে , যদিও আমি একটিরও অস্তিত্ব টের পেলাম না । হঠাৎ করে দেখি সমগ্র ভ্যালিটিকে ঘিরে ধরেছে ধোঁয়ার মতো মেঘের রাশি , যা আমাদের অল্প ভিজিয়ে দিয়ে গেল । ক্রমশ আকাশ জুড়ে আলো কমতে শুরু করল আর আমরা রওনা দিলাম বাংলোর উদ্দেশ্যে । ফেরার পর বাংলোর ম্যানেজার মিস পেমা আমাদের নিয়ে গেলেন সূর্যাস্ত দেখার জন্য । সূর্যাস্তের শোভা যে এত অপরূপ হতে পারে জীবনে প্রথমবার আমি তার সাক্ষী থাকলাম । সমগ্র আকাশ জুড়ে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে , তুলোর মতো জমাট বাধা ঘন মেঘের অন্তরালে ধীরে ধীরে সূর্য্য মুখলুকোচ্ছে । একসময় পুরো সূর্য্যটাই চলে গেল মেঘের অন্তরালে আর সমগ্র নাথাং এর বুকে দিয়েগেল সন্ধ্যা । এর সাথে সাথেই আমরা আশ্রয় নিলাম বাংলোব্র অন্দরে । বাংলোব্র মধ্যে থাকা সাউন্ড বক্সে পুরনোদিনের মনমাতানো হিন্দি গান শুনতে শুনতে চা ও মোমো সহযোগে আমরা জলখাবার সারলাম । বাংলোর জানালা দিয়ে চাঁদের আলোয় নাথাং-এর মায়াবী রূপ প্রবল হাওয়ার ও ঠান্ডার মধ্যেও আমাদের বাংলোর বাইরে আনতে সক্ষম হলো । বাইরে বেরিয়ে দেখি সমগ্র আকাশ তারায় তারাময় । চাঁদের রুপালী আলোয় ডুব দিয়েছে সমগ্র নাথাং ভ্যালি । সেই আলোয় চিকচিক করছে পাহাড় খাঁজে জমে থাকা বরফ রাশি । হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হওয়ায় বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে না পেরে বাংলোর ভেতরে চলে এলাম । ভেতরে তখন ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে । নৈশভোজ সেরে আগুনের উষ্ণতায় নিজেকে কিছুটা সতেজ করে পাড়ি দিলাম ঘুমের দেশে ।
কিভাবে যাবেন :
নিউ জল্পাইগুড়ি থেকে খুব্সকালে বেরিয়ে সরাসরি নাথাং যাওয়া যায় , তবে একরাত জুলুকে থেকে পরদিন যাওয়াই ভালো ।
কোথায় থাকবেন :
নাথাং-এ থাকবার জায়গা মাত্র দুটি - ডাফটার বাংলো ও পিনাসা হোমস্টে । ডাফটার বাংলোটি বেশ ভালো ।তবে অবশ্যই আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়া দরকার । যোগাযোগ: মিস পেমা শেরপা-৯৪৭৪১৪৫৯৫৮, মিস্টার বিজয় সুব্বা-৯৪৩৪১৩১৭৩৭, ৯৮৩২৫৫৩৩৮৭, তথ্যের জন্য: ৮১০০৭৯০২০৬
জরুরী তথ্য :
নাথাং ভ্যালির উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩৫০০ ফুট , তাই শ্বাসকষ্ট বা হার্টের সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন ।নাথাং ভ্যালি যাওয়ার জন্য বন দফতরের (ডি. এফ. ও) ছাড়পত্রের প্রয়োজন , এই ব্যাপরে আপনার ট্রাভেল এজেন্ট বা গাড়ির ড্রাইভার বা হোমস্টে কত্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন । মনে রাখবেন নাথাং এ পৌছনোর জন্য বিকেল চারটার মধ্যে অবশ্যই রংলি পৌঁছতে হবে ।
লিখলেন অভিব্রত ভক্ত
ফটোগ্রাফার সাগ্নিক মজুমদার