সর্বপ্রথম হাই হিল জুতো পরেন পুরুষেরা!
ফ্যাশন সচেতন নারী মানেই তার সম্পত্তির তালিকায় একটা হলেও হাই হিল জুতো বা স্যান্ডাল আছেই আছে। কিন্তু নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক এই হাই হিলের ব্যাপারে একটি তথ্য অনেকেই জানেন না আর তা হলো, হাই হিল পরার প্রথা সর্বপ্রথম চালু হয় পুরুষদের মাঝে! শুধু তা-ই নয়, অতীতে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পুরুষের স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হতো হাই হিল জুতো!
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যে হাই হিল পরার প্রচলন ছিল। কিন্তু এই হাই হিল হাঁটার জন্য নয়, বরং যুদ্ধের সময়ে ব্যবহৃত হতো। কিভাবে? ঘোড়ার পিঠে চড়ে থাকা অবস্থায় রেকাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে যেতে হতো এবং তীর ছুঁড়তে হতো। এ সময়ে হাই হিল পরা থাকলে রেকাবে পা আটকে রাখা সহজ হতো। শুধুমাত্র এ কারণেই তীরন্দাজরা হাই হিল পরতেন। ১৫৯৯ সালে পারস্য থেকে প্রতিনিধি আসে রাশিয়া, জার্মানি এবং স্পেনে। সে সময়েই হাই হিলের ফ্যাশন সম্পর্কে জানতে পারে ইউরোপীয়রা।
১৬শ শতকের দিকে ইউরোপীয় সমাজে এই প্রথা শুরু হতে দেখা যায়। তখন সমাজের ধনী শাসক গোষ্ঠী অর্থাৎ “এলিট” পুরুষেরা নিজেদের ঠাটবাট জাহির করার জন্য হাই হিল পরা শুরু করে। এর পেছনের কারণটা দেখা যাক। হাই হিল পরলে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে সমস্যা হয়। আর সমাজের নিম্ন মর্যাদার সাধারণ মানুষের সেই অবকাশ ছিল না যে তারা হাই হিল পরে কাজ না করে বসে থাকবে। সমাজে যারা উচ্চ মর্যাদার মানুষ (অর্থাৎ যাদের কোনরকমের পরিশ্রম করতে হতো না), তারাই শুধুমাত্র হাই হিল পরার মতো বিলাসিতা করতে পারতো। পদমর্যাদা বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে হাই হিল পরা শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরুষের কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৬৩০ সালের দিকে নারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পুরুষের কর্তৃত্ব খর্ব করার জন্য তাদের মতো পোশাকআশাক পরা শুরু করে। ধূমপান, পুরুষালী হ্যাট পরা, চুল ছোট করা, পোশাকে অ্যাপিউলেট(কাঁধে লাগানোর ঢাকনাবিশেষ) লাগানো শুরু করে এবং তার পাশাপাশি হাই হিলও পরা শুরু করে। তার পর? তার পর নিম্ন মর্যাদার মানুষের মাঝেও ফ্যাশন হিসেবে হাই হিল পরা শুরু হয়। কিন্তু উঁচু শ্রেণী আর নিচু শ্রেণীর মানুষের জুতো একই রকম হয়ে গেলে উঁচু শ্রেণীর মানুষের মর্যাদা খর্ব হবে যে! নারী এবং নিম্ন শ্রেণীর মানুষের চাইতে নিজেদেরকে আলাদা করে তুলতে পুরুষেরা নিজেদের হিলের উচ্চতা বাড়িয়ে তোলে। আবার পুরুষ এবং নারীর হাই হিলের মধ্যেও পার্থক্য তৈরি করে দেওয়া হয়। নারীরা পরত চিকন হিল এবং পুরুষেরা পরত মোটা হিল।
ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই ছিলেন হাই হিল পরার ব্যাপারে সবচাইতে বিখ্যাত। মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার এই শাসক নিজের উচ্চতা বাড়াতে কমপক্ষে চার ইঞ্চি উচ্চতার হাই হিল পরতেন। এখান থেকে ইংল্যান্ডের রাজন্যবর্গের মাঝেও এটা ছড়িয়ে যায়। চতুর্দশ লিউ ১৬৭০ সালের দিকে নিয়ম করে দেন, শুধুমাত্র তার রাজসভার সদস্যরা লাল রঙের হিল পরতে পারবেন। ফলে কারও পায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যেত তিনি রাজার প্রিয়পাত্র কি না।
পুরুষ কেন এখন আর হাই হিল পরে না? কেন তারা হাই হিল পরা বন্ধ করে দিল? তার কারণ হলো নারীরা হাই হিল পরে পরে এর পুরুষালী আবেদন কমিয়ে দিচ্ছিল! ফলে হাই হিল পরার ওপর থেকে পুরুষেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ১৭৪০ সালের দিকে পুরুষের হাই হিল পরার চল উঠে যায়। ফরাসি বিপ্লবের পরে হাই হিলের চল নারীদের মাঝে থেকেও উঠে যায়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি দিকে এসে ফটোগ্রাফির একটা ঝোঁক দেখা যায় সবার মাঝে। তখন আবার হাই হিল নারীদের মাঝে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের হিল পরার অভ্যাস চালু আছে নারীদের মাঝে। সমকামি পুরুষেদেরও মাঝে মাঝে হিল পরতে দেখা যায়। এখন আর সামাজিক মর্যাদা হিসেবে পুরুষেরা হাই হিল পরে থাকেন না। কিন্তু কেউ যদি হাই হিলকে মেয়েদের বৈশিষ্ট্য বলে জাহির করবার চেষ্টা করে তবে তাকে মনে করিয়ে দেবেন, এক সময় পুরুষের থেকেই এসেছে এর প্রচলন!
লেখক মুশফিকুল হক মুকিত (বাংলাদেশ)
No comments